বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন আইন সংশোধন: চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

Abu Sayed
3 min read4 days ago

--

বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন আইন সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা, প্রস্তাবিত পরিবর্তন এবং এর প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা। নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আইনি কাঠামো শক্তিশালীকরণের উপায়।

বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন আইন সংশোধনের ব্যাপারে আমার মতামত

দুর্নীতি যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের পথে একটি বড় বাধা। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। যদিও গত কয়েক দশকে দেশে দুর্নীতি দমনে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, কিন্তু বদলে যাওয়া পরিস্থিতি ও নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিদ্যমান আইনি কাঠামো অনেকাংশেই অপর্যাপ্ত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এই প্রেক্ষাপটে দুর্নীতি দমন আইন সংশোধনের দাবি উঠেছে। আসুন জেনে নেই এই সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা ও প্রস্তাবিত পরিবর্তনগুলো সম্পর্কে।

দুর্নীতি দমন আইন সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা

বর্তমান আইনের সীমাবদ্ধতা

বর্তমানে বাংলাদেশে ২০০৪ সালের দুর্নীতি দমন আইন কার্যকর রয়েছে। কিন্তু গত প্রায় দুই দশকে দুর্নীতির ধরন ও প্রকৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। বিশেষ করে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার দুর্নীতির নতুন নতুন পথ খুলে দিয়েছে। ফলে বর্তমান আইনে এসব নতুন ধরনের দুর্নীতি মোকাবেলায় পর্যাপ্ত বিধান নেই।

প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ

ক্রিপ্টোকারেন্সি, ব্লকচেইন প্রযুক্তি, ডার্ক ওয়েব ইত্যাদির মাধ্যমে এখন সহজেই অবৈধ অর্থ পাচার ও দুর্নীতি লুকানো সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু বর্তমান আইনে এসব বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা নেই। ফলে তদন্তকারী সংস্থাগুলো অনেক সময় আইনি জটিলতায় পড়ছে।

আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ

জাতিসংঘের দুর্নীতি বিরোধী কনভেনশনসह বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তিতে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে। এসব চুক্তির শর্ত পূরণে আমাদের আইনি কাঠামোকে আরও শক্তিশালী ও যুগোপযোগী করা প্রয়োজন।

প্রস্তাবিত সংশোধনী

দুর্নীতির সংজ্ঞা বিস্তৃতকরণ

ডিজিটাল ও সাইবার দুর্নীতি

বর্তমান আইনে দুর্নীতির সংজ্ঞা প্রধানত ঘুষ, আত্মসাৎ ও প্রভাব বিস্তারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু বর্তমান যুগে ডিজিটাল মাধ্যমে নানা ধরনের দুর্নীতি সংঘটিত হচ্ছে। যেমন:

  • অনলাইন ব্যাংকিং জালিয়াতি
  • সাইবার হ্যাকিং এর মাধ্যমে তথ্য চুরি ও ব্ল্যাকমেইল
  • ফেক নিউজ ছড়িয়ে প্রভাব বিস্তার
  • সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে অবৈধ লেনদেন

এসব ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট আইনি বিধান থাকা প্রয়োজন।

কর্পোরেট দুর্নীতি

বড় কর্পোরেশনগুলোর দুর্নীতি প্রায়ই ব্যক্তিগত দুর্নীতির চেয়ে বেশি ক্ষতিকর। তাই কর্পোরেট দুর্নীতির স্বতন্ত্র সংজ্ঞা ও শাস্তির বিধান রাখা উচিত। এর মধ্যে থাকতে পারে:

  • ট্যাক্স ফাঁকি
  • শেয়ার বাজার ম্যানিপুলেশন
  • পরিবেশ দূষণ গোপন করা
  • নিরাপত্তা বিধি লঙ্ঘন

শাস্তির কঠোরতা বৃদ্ধি

জরিমানা ও কারাদণ্ড বৃদ্ধি

বর্তমান আইনে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু বড় ধরনের দুর্নীতির ক্ষেত্রে এটি যথেষ্ট নয়। প্রস্তাব করা হচ্ছে:

  • ১ কোটি টাকার বেশি দুর্নীতির ক্ষেত্রে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রাখা
  • জরিমানার পরিমাণ দুর্নীতির অঙ্কের সমান বা দ্বিগুণ করা
  • পুনরায় অপরাধের ক্ষেত্রে শাস্তি দ্বিগুণ করা

সম্পদ বাজেয়াপ্তকরণ

দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সকল সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার আইনি বিধান থাকা উচিত। এক্ষেত্রে প্রমাণের দায়িত্ব অভিযুক্তের উপর থাকবে। অর্থাৎ অভিযুক্তকে প্রমাণ করতে হবে যে তার সম্পদ বৈধভাবে অর্জিত।

হুইসলব্লোয়ার সুরক্ষা

দুর্নীতি প্রকাশে হুইসলব্লোয়ারদের ভূমিকা অপরিসীম। কিন্তু বর্তমানে তাদের সুরক্ষার জন্য পর্যাপ্ত আইনি বিধান নেই। নতুন সংশোধনীতে থাকতে পারে:

  • হুইসলব্লোয়ারদের পরিচয় গোপন রাখার বাধ্যবাধকতা
  • তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া হলে কঠোর শাস্তির বিধান
  • সত্য তথ্য প্রকাশের জন্য আইনি ইমিউনিটি প্রদান
  • দুর্নীতি প্রমাণিত হলে হুইসলব্লোয়ারকে পুরস্কৃত করার বিধান

কর্পোরেট দায়বদ্ধতা

বড় কোম্পানিগুলোর দুর্নীতি রোধে কর্পোরেট দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা জরুরি। এজন্য প্রস্তাব করা হচ্ছে:

  • কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা
  • কর্পোরেট দুর্নীতির ক্ষেত্রে কোম্পানির লাইসেন্স বাতিলের বিধান রাখা
  • কোম্পানির বার্ষিক অডিটে দুর্নীতি বিরোধী ব্যবস্থা পর্যালোচনা বাধ্যতামূলক করা

সংশোধনীর সম্ভাব্য প্রভাব

ইতিবাচক প্রভাব

  • দুর্নীতি হ্রাস: কঠোর শাস্তির ভয়ে অনেকে দুর্নীতি থেকে বিরত থাকবে
  • বিনিয়োগ বৃদ্ধি: দুর্নীতি কমলে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে
  • সুশাসন প্রতিষ্ঠা: দুর্নীতি কমলে সরকারি সেবার মান বাড়বে
  • আর্থিক স্বচ্ছতা: কর্পোরেট দায়বদ্ধতা বাড়লে আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা আসবে

সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ

  • আইন প্রয়োগের জটিলতা: নতুন ধরনের দুর্নীতি তদন্তে দক্ষতার অভাব
  • রাজনৈতিক বাধা: ক্ষমতাসীন মহল থেকে বাধা আসতে পারে
  • সামাজিক প্রতিরোধ: দীর্ঘদিনের দুর্নীতি সংস্কৃতি পরিবর্তনে সময় লাগবে

পরিশেষে বলতে চাই

দুর্নীতি দমন আইন সংশোধন একটি জটিল কিন্তু অত্যন্ত জরুরি কাজ। শুধু আইন পরিবর্তন নয়, এর সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য প্রয়োজন সরকার, সুশীল সমাজ ও সাধারণ নাগরিকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। আশা করা যায়, যুগোপযোগী ও কার্যকর দুর্নীতি দমন আইনের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত দেশ হিসেবে বিশ্বে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করতে পারবে।

--

--

Abu Sayed

Bangladeshi Full Stack Web Dev, Sys Admin & DevOps Engineer. Skills: Data analysis, SQL, Kubernetes. Python, PHP & Laravel. Me on: bd.linkedin.com/in/imabusayed